Monday, February 7, 2022

ভুলে গেছি, কিছুটা ভুলছি

 মুহাম্মদ নাজমুল হক 


তোকে ভুলতে ভুলতে আজ লিখতে বসেছি 

ভুলে যাওয়া কথা গুলি অগোছালো, 

ভুলতে থাকা মুহূর্তগুলো ঝাপসা! 

কিছুটা ভুলেই গিয়েছি কতগুলো ভুলছি। 

হঠাৎ যখন মনে হয়, তুই কত কাছের 

তারপর খুজতে থাকি তোকে, সেইদিন -

সুন্দর মুহুর্ত, রাস্তা, প্রেম - অভিমান। 

সেই বিকেল, ফুচকা, ভরা বাস, 

সেই গোধূলি, তোর লাবণ্য, সাত জনমের ভালোবাসা। 

অথচ! 

আজ সুন্দর মুহুর্ত, চা কিংবা ভালোবাসা কোনটাই 

যেন নেই লেখার মতো! 

ভুলে গেছি, কিছুটা ভুলছি। 

আর কিছুদিন পর হয়তো ভুলেই যাবো -

এই কবিতা, তোর শহর, তোর হাসি। 

এরপর আরো কিছুদিন পর হয়তো 

মনেই থাকবেনা তুই বলে কেউ ছিলি। 

Thursday, October 21, 2021

একদিন তোকে অবাক করে দিবো

 একদিন তোকে অবাক করে দিয়ে 

তোর সামনে এসে দাঁড়াবো, 

অথচ কতকাল তোর সঙ্গে দেখা নেই

বিহব্বল তুই  বিস্মিত। 

ঠাঁই দাঁড়িয়ে তুই স্থির, হৃদয় উচ্ছ্বল।


এত কাছে যাবো তোর 

যেখান থেকে হৃদয় ধ্বনি শোনা যায়। 

এরপর আরো কাছে, অনুভবে হৃদকম্পন, 

তোর উষ্ম নিঃশ্বাস আমার কাধে। 

আঁখি জলে ঝাপসা চেহারা, কথা কবো ইশারায়। 


আরেকবার, আরেকদিন, অবেলায় 

আকাশে মেঘ ঘন, ঝটিকা ঝড়, বৃষ্টির ক্ষণ 

ভিড়ের শেষে এক কোণে,

তোকে অবাক করে দিয়ে 

জড়িয়ে ধরে আমি চুমু খাবো। 

যেন পাথর হবি তুই ভয়ে লজ্জায় 

হঠাৎ তাড়িৎ চমকিত শীতল তুই, 

যেন লুকিয়ে পালাতে চাইবি আমার শক্ত বাহুবন্ধনে।



Tuesday, December 8, 2020

অপেক্ষা

মুহাম্মদ নাজমুল হক  


(এক)

জীবনে কত মানুষের সাথেই না আমাদের পরিচয় হয়। এমন অনেক মানুষের সাথে আমাদের দেখা হয়, কথা হয় খুব অল্প সময়ের জন্য,- হাট-বাজারে, বাস স্টান্ডে, রেলের কামরায়। হয়ত তাদের সাথে জীবনে কখনো আর দেখা হবেই না ! তেমনি, কখনো ভাবিনি এই গল্পটা এতদূর এগুবে।    

১১ মে। বৈশাখের শেষ সপ্তাহ। এক সপ্তাহ বিষাদময় গরম শেষে গত দুদিন পাল্লা দিয়েছে কখনো তুমুল বৃষ্টি তো কখনো টিপটিপ বৃষ্টি। আজ সকাল অবশ্য রোদ ঝলমলে। বিশেষ মনোযোগ দিয়ে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলাম "ঢাকার স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের কোমড় ব্যথা ও তার প্রতিকার" শিরোনামে। হঠাৎ ডোর বেলের আওয়াজে উঠতে হলো। দড়জায় বাসাওয়ালা আন্টি দাড়ানো। নিজে একটু অপ্রস্তুত ও আশ্চর্য হলাম এই সময়ে তো উনার আসার কথা নয়!  অপ্রস্তুতভাবে বললাম - জ্বী আন্টি...... 

ইয়ামিন, তো তুমি বোধহয়?  বললেন উনি। 

জ্বী। আমি। 

তোমার চিঠি। আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিড়বিড় করে  বললেন - আজকালকার জামানায় কে আর চিঠি বিনিময় করে। সাথে হিন্দি অথবা উর্দুতে আরো কয়েক কথা বললেন তা বুঝতে পারলাম না। 

আমি যেমন অপ্রস্তুত ছিলাম উনিও তেমনি বিব্রতবোধ করছিলেন কেননা আমি অর্ধানগ্ন ছিলাম। কার চিঠি হতে পারে, কে লিখলো? খামের উপরের নাম দেখে বুঝতে পারছিলাম না। কেউ কি আমার সাথে মজা করছে?  বুঝতেছিনা! 

বাধ্য হয়ে হাতের কাজ কর্ম রেখে খামটা খুলে পড়তে লাগলাম। 


১০/১০/২০১৮

প্রিয় বন্ধু ইয়ামিন,

পত্রের প্রথমে আমার পরিশ্রমে তৈরি বাগানের সদ্য প্রস্ফুটিত লালগোলাপের শুভেচ্ছা। আর আমার শেষ রক্ত বিন্দু ভালোবাসা। জানি অবাক হচ্ছ! আমাকে চিনতে মনে হয় খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার! কারো প্রথমে সাক্ষাতের পর কেউ এভাবে মনে রাখেনা নিশ্চয়? কিন্তু আমার কেমনজানি সবটুকু মনে আছে সেদিনের কথা। রাজশাহী টু ঢাকা সিল্কসিটি এক্সপ্রেসের 'জ' কামরাতে তোমার সাথে আমার প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। 

এতক্ষণে যদি তোমার আমাকে মনে পড়ে তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। আমি যদি ভুল না করে থাকি তুমি এতদিনে ডাক্তার হয়ে গেছো। আমার যেমন সেদিনের সব কথা পর্যাক্রমে সবটুকু মনে আছে। আশাকরি এতক্ষণে তুমিও সবকিছু মনে করতে পেরেছো। 

আমি জানিনা এই চিঠি তোমার কাছ অবধি পৌছাবে কি'না? যদি না পৌঁছায় তাহলে আমি একদিন না হয় আত্না হয়েই তোমার সাথে দেখা করবো। সেদিন তোমার যেমন বেশকিছু আশা আকাঙ্ক্ষা ছিলো। তেমনি আমারো একটা উচ্চাশা ছিলো। মানুষের জন্য কিছু করবো। মানুষ একজীবনে আর কয়দিন বাঁচে বলো? এই স্বল্পসময়ে যদি মানুষকে ভালো না বাসতে পারি তবে আমাকেই বা কয়জন ভালোবাসবে? আমি জানিনা আমি আমার স্বপ্ন পুরন দেখে যেতে পারবো কি'না! আমি চাই তুমি আমার অসুম্পুর্ন স্বপ্নটুকু পূরণ করে দিবে! এ আমার  বিশ্বাস, বন্ধুর প্রতি আমার ভরসা। আমার এই ভয়ের পিছনে বেশকিছু কারণ আছে। যেমন ধরো ইদানীং আমার রাতের বেশি সময় অনিদ্রায় কাটে, ঘুমের মধ্যে কেমন অদ্ভুদ স্বপ্ন দেখি, মাঝে মাঝে আমার চিন্তাগুলো হিংসাত্মক হয়ে ওঠে , আবার কখনো কখনো আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে! বন্ধ ঘরেই বেশ স্বত্তি পায়। যদি না রাশেদ ভাইয়ের দেয়া ওষুধ থাকতো আমি মনে হয় এতদিনে মারা যেতাম। এমন আরো কিছু সমস্যা অনুভুত হচ্ছে আমার জীবনে। একটা ট্যাবলেট খেলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় নিজেকে বেশ চনমনে  লাগে। ধন্যবাদ রাশেদ ভাই।    তুমি যেহেতু ডাক্তার মানুষ তাই তোমায় বলছি। 

আশাকরি আমার চিঠি পাওয়ার পরেই তুমি চলে আসবে। তুমি আসলে আরো অনেক কথাই মন খুলে বলতে পারবো। 


অপেক্ষায়, 

অরণ্য 

পিতাঃ মাহতাব মন্ডল  

পোস্ট + থানাঃ নাটোর সদর

জেলাঃ নাটোর    


এতক্ষণে আমার সেদিনের প্রায় সবকিছু মনে পড়েছে। সময়টা বোধহয় ২০১৫ সাল। খুব গরম ছিলো, সাথে কখনো কখনো হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি তো আবার  প্রচন্ড গরম। সেই হিসেবে ভাদ্র মাসের কোন একদিন হবার কথা। আমি রাজশাহী থেকে ট্রেনে চেপেহিলাম গন্তব্য ঢাকা। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পরেও আমার পাশের সিট খালি ছিলো। একপ্রকার মানসিক দুঃচিন্তায় ছিলাম, খুব সম্ভবত আমার আইটেম পরীক্ষা ছিলো! না না আমার  সেকেন্ড প্রফের ভাইভা শুরু হবার কথা। মানসিক অশান্তির দরুন ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর পর দুচোখ বন্ধ করে ছিলাম ; হয়ত কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলাম। হঠাৎ নাটোরের কোন এক স্টেশনে (খুব সম্ভবত গুরুদাসপুর) কারো ধাক্কায় তন্দ্রাভাব দূর হলো। দুচোখ মেলতেই লোকটা বলল -

- সরি। লোকটা তার হ্যান্ড লাগেজ টা উপরের কেবিনেটে রাখছিল। 

আমি বেশ বিরক্তি ভাব নিয়েই দেখছিলাম। তাছাড়া আমার সিটটা ভিতরের দিক ছিলো তাই উনার পা আমার শরীরের সাথে লাগছিলো। আমি নিজেকে একটু সরিয়ে নিলাম ভিতরের দিকে। লাগেজটা রেখে লোকটা আমাকে বললো -

 - আপনি চাইলে জানালার পাশে বসতে পারেন।

- না না ঠিক আছে। আমি উনাকে জাগয়া করে দিলাম বসার জন্য। 

- বাই দ্য ওয়ে, আপনার নামটা বলা যাবে? 

- ইয়ামিন 

- বাহ! আপনি তো দেখি ডান পন্থি। নির্ভিক। আপনি দেখি খুব সৌভাগ্যবান  

- কি করে?  আপনি জোত্যিশবিদ নাকি..... 

- আরে না, না, বলেন কি। এই ইয়ামিন নামের মানুষরাই সবসময় সফল হয় 

- তাই। যাক ভালোই তাইলে। আর আপনি? 

- আমি। আমি আনলাকি থার্টি... 

- কে বলেছে? আপনি আনলাকি হতে যাবেন কেন। বেশ সাবলীল আর স্মার্ট আপনি। চাইলে অনেক ভালো কিছু করতে পারবেন। 

- আপনি বলছেন 

- হু। আপনার নামটা কিন্তু এখনো বলেননি?     

- আমার নাম? ওই যে সামনে তাকিয়ে দেখেন ওটাই আমি। লোকটা আমাকে দূরের সবুজে ঘেরা বাগান অথবা লোকালয় দেখিয়ে আমাকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। 

- মনে মনে হিসেব নিকেস করে সবুজ, প্রকৃতি  অতঃপর বললাম অরণ্য? 

- জ্বি। বলেছিলাম না   সফল  মানুষ আপনি। 

- এটা কিন্তু আপনি বাড়িয়ে বললেন। এটা যে কেউ পারার কথা। 

- না মশাই না। এর আগেও তো অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি এইভাবে এত কম সময়ে কেউ বলতে পারেনি। কই আপনি তো সবুজ বলতে পারতেন কিন্তু বলেন নি। আচ্ছা যাইহোক কি করেন? 

- মেডিকেলে পড়ছি। আপনি?  

- দেখলেন!   সব মিলে যাচ্ছে, আগেই বলেছিলাম সফল মানুষ হবেন। আমার কথা আর কি বলবো একটা ডিগ্রীকলেজ থেকে বিবিএ থার্ড ইয়ারে আছি। সাথে  বাবার ব্যবসায় সাহায্য করি।  

এরপর আরো অনেক কথায় হয়েছিলো সারা রাস্তায়। প্রথম দিকে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম পরে সমস্ত ভ্রমণ বেশ ভালো হয়েছিলো। জীবনের সেরা ভ্রমণের একটি ছিলো এটি। এক অদ্ভূত মানুষ ছিলেন বটে। এক পর্যায়ে অরণ্য আমার ঠিকানা ওর পকেট নোটে লিখে নিয়েছিলো। আমিও জেনেছিলাম ওর ঠিকানা। নাটোর সদর উপজেলায় ওর বাসা। গুরুদাসপুরে ওর বোনের বাসা।          

আগেই বলেছি আমাদের সফর সঙ্গি হিসেবে আমরা দুজনে কেমন মানিয়ে গিয়েছিলাম। সময় খুবি অল্প কয়েক ঘন্টা মাত্র। অথচ মনে হয়েছিলো কতদিনের বন্ধু আমরা। তারুপর আমরা একি ব্যাচমেট ছিলাম। একসময় আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলি। আমি আর কথা বলি সে তার প্লান বলে। এই পর্যায়ে সে বলল তার মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা। তার বাড়ি নাটোর সদর হলেও জায়গাটা বেশ মফস্বল। শহর থেকে বাইরে অটোরিকশা নিলে বিশ টাকা ভাড়া লাগে। সেখানকার মানুষ খুব সচ্ছল না হলেও অসচ্ছল ও নয়। মানুষগুলো বেশ পপরিশ্রমি। ওদের ওখানটায় ভালো স্কুল নেই, যদিও একটা সরকারি প্রাইমারী স্কুল আছে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা খুব সুবিধার নয়। এইজন্য এখানে শিশুশ্রম চোখে পড়ার মতো। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এখানকার স্থানীয় প্রসাশন কিছুই বলেনা। এমনকি এইসব শিশুরা এই অঞ্চলের দেশীয় নামি কোম্পানিতে কাজ করে। ওই মানুষটার হৃদয় কত কোমল তা একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। সে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানাজমেন্ট বিষয়ে পড়া বাদ দিয়ে নাটোর ডিগ্রিকলেজ থেকে বিবিএ পড়তেছে। আর প্রতিদিন সময় করে এলাকার বাচ্চাদের পড়ায় কয়েকটা ব্যাচে! মহান মানুষরা বুঝি এমনি হয়। 

(দুই)

  হঠাৎ চিঠি পাওয়াতে অবাক হলাম। তাছাড়া চিঠিটা আরো প্রায় পাঁচ মাস আগের লেখা! এমন তো নয় যে সে বিদেশ থেকে লিখেছে? আর পৃথিবীর যেই প্রান্ত থেকেই লিখুক না কেন বর্তমানে তা পেতে আশাকরি পাঁচ  মাস লাগার কথা নয়! 

সন্দেহ আর দুঃচিন্তার মাঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা! আমার কি যাওয়া উচিত?


  এই অভ্যেটা আসলেই বাজে। ট্রেন কবেই নাটোর ছেড়েছে আমার কোনো হুশ নাই। আরো কয়েকঘন্টা আমার জীবন থেকে নষ্ট হলো। আবার পুনরায় বাসে করে নাটোর পৌঁছালাম। এবার একটা অটো রিক্সা করে নাটোর-রাজশাহী হাইওয়ে থেকে গ্রামের সরু রাস্তায় উপর দিয়ে রিক্সা চলছে আপন মনে। গ্রাম হলে কি হবে প্রায় সব রাস্তায় দেখি পিচ ঢালা কোথাও আধা পাকা। অথবা কে যেন কবে রাস্তা পাকা করে গেছে পরে আর যত্ন নেওয়া হয়নি যার ফলপ্রসু রাস্তার এই বেহাল অবস্থা। রাস্তার পিচগুলো উঠে গেছে কোথাও কোথাও বেশ গর্ত হয়ে গেছে। গত রাতে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছিল এখনো রাস্তার গর্তে পানি জমে আছে। সর্বোপরি গ্রাম বেশ সুন্দর। যেন বইয়ে পড়া কোন রূপসী গাঁ! সবুজে ঘেরা। রাস্তার দু পাশে বেশিরভাগ আম গাছ, এরপর কিছু আকাশমনি, মেহগনি ও আছে। আর মাঠ ভর্তি ধান, বোরোধান। কিছুদিন পরেই কাটার মৌসুম চলে আসবে। আমগুলো এখনো অপরিপক্ক। অটোরিকশাওয়ালা সম্ভবত ওই গ্রামের কেননা পুরো রাস্তায় কোথাও থামেনি। মাঝে দু-চারটে কথা হলো, যেমন উনার ছেলেমেয়ে কয়টা তারা কি করে। 

একটা দুতলা বাড়ির সামনে এসে অটো থামলো। তারমানে অরন্যরা এলাকার প্রতাপশালী পরিবারের একজন। বাড়ির সামনে বেশ ফাকা জায়গা আছে। সেখানে কয়েকটা বড় আম গাছ, দুটা লিচু গাছ বাড়ির দক্ষিন কোনায় একটা পেয়ারা গাছ। উঠানের শেষে একটা  পুকুর আছে। পুকুরের উঠানের দিকটায় একটা সানবাধানো ঘাট,  আর চার পাশে কিছু সুপারি গাছ, কয়েকটা তাল গাছ আর এদিকের প্রধান আম গাছ ও আছে। 

 - এটাই অরন্যদের বাড়ি। আর ওইলোকটা অরন্যের বাবা। বললেন অটোওয়ালা। 

   - আচ্ছা।ধন্যবাদ। এই নাও ভাড়া। 

এখন বাড়িটা বেশ নিরব। তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে কিছুক্ষণ আগেও অনেক মানুষ ছিলো এখানে। তার চিহ্ন স্পস্ট।  কেননা বেশকিছু চেয়ায়, বসার টুল উঠানের পূর্বদিকে ছড়ানো আছে। মনে হয় কোন শালিস বসে ছিলো।  এরা তো আবার মন্ডল পরিবারের সদস্য। আর দেশের এই উত্তরাঞ্চলে মন্ডলরা বেশ প্রতাপশালী। 

মাহাতাব মন্ডল একাই বসে আছেন আর আমাকে বিশ্লেষণ করছেন হয়তোবা। রিক্সাওয়ালা চলে গেল আর আমি সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। উনার স্থিরদৃষ্টি আমার উপর। মনে মনে কিছু ভাবছেন? 

 - আসসালামু আলাইকুম।

 উনি সালামের জবাব দিলেন কি না বুঝলাম না। মুখটা অবশ্য নড়ল কিন্তু কোন শব্দ বেরুলোনা। অথচ এখনো উনার দৃষ্টি স্থির। আমি উনার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম।বললাম        

 - আংকেল। আমি ইয়ামিন । অরন্যের বন্ধু। 

এটা কি করে হতে পারে। ও মাই গড! উনি তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন! আমি দ্রুত উনার পালস দেখলাম নাড়ির গতি খুবি কম। চেহারাটাও কেমন শুষ্ক আর ফ্যাকাশে ;- হাইপোক্সিয়া (?)  মনে হয় গত রাত থেকে কিছু খায়নি। আর নার্ভেও প্রচুর চাপ পড়ে আছে। ইলেক্ট্রলাইট ইমব্যালান্স(Electrolytes Imbalance)    হয়ে গেছে মনে হয়। 

বাধ্যহয়েই চিৎকার করতে হলো। বাড়িতে কেউ আছেন? তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন? অরন্যের বাবা অসুস্থ হয়ে গেছেন। কয়েকবার চিৎকার করতেই কয়েকজন মহিলা প্রায় দৌড়ে বেড়িয়ে এলেন। আমি অরন্যের বাবাকে ধরাধরি করে টুলে শুইয়ে দিলাম আর বললাম দয়াকরে কেউ একগ্লাস গ্লুকোজ পানি নিয়ে আসুন। অথবা বেশিকরে চিনি দিয়ে পানি নিয়ে আসুন, স্যালাইন হলেও চলবে । 

প্রায় দশমিনিট পর উনার পুরোপুরি  জ্ঞান ফিরলো। আমি বললাম এখন কেমন লাগছে আংকেল? এখন উঠে বসেন। এই দশমিনিটে আমি এই বাড়ির মানুষদের মুটামুটি চিনে ফেলেছি । তাই অরন্যের মাকে বললাম 

- আন্টি। উনাকে কিছু খেতে দেন। মনে হয় কাল থেকে না খেয়ে আছেন 

এইজন্য অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। আর আংকেল আপনার যদি ওয়াশরুমে যেতে হয় বলবেন। 

পিছন থেকে কে যেন বললেন রাশেদ ডাক্তারকে ফোন করা হয়েছে কি? 

জ্বী ফুপি। আমি রাশেদ ভাইকে কল দিয়েছিলাম চলে আসবেন এখনি। আমার ডান পাশের এক সুন্দরী মেয়ে বলল। 

- কোন ভয় নেই। আমি ডাক্তার ইয়ামিন, অরন্যের বন্ধু। 

- আপনি ইয়ামিন? বলল মেয়েটি। 

- জ্বী আমিই। 

- গত ছ মাসে অন্তত ছয়শ বার আপনার নাম শুনেছি। 

এতক্ষণে অরন্যের মা চলে এসেছেন। ইয়ামিন ভিতরে  চলো বাবা। তুমি এলেই কিন্তু বড্ড দেরীতে এলে! 

বলতে গেলে অরন্যের বাবার কপালটা খুব ভালো। কেননা উনি ব্রেইন স্ট্রোক করলেও করতে পারতেন। আমি এখন বাড়ির ভেতরের বারান্দায় বসা। সান দিয়ে মাজা পুরো বারান্দা। আমি যে ঘরে গিয়েছিলাম সেই ঘর অবশ্য টাইলস করা। ওয়াশরুমটাতে মার্বেল কালারের টাইলস করা ছিলো। বাইরের দেয়াল গুলো হালকা অরেজ্ঞ কালারের। সম্ভবত নিচে কেউ থাকেনা শোবার ঘর উপরে। এটা বারান্দা হলেও শহুরে ড্রইংরুমের কাজ চলে। যদিও সোফা নেই। কিন্তু কাঠের চেয়ারে কেমন মানিয়ে আছে। মাথার উপরে একটা সবুজ রংয়ের ফ্যান চলছে। আমি এবাড়িতে এসেছি প্রায় পৌনেএকঘন্টা হবে।  অথচ অরন্যকে দেখতে পেলাম না ! সে কি কোথাও বিশেষ কাজে গেছে? বড় বড় মানুষের কত কাজ থাকে প্রয়োজনীয়  অপ্রয়োজনীয় ! 

অরন্যের মা এলেন কিছু খাবার  বিস্কুট, কেক পানীয় নিয়ে। খাও বাবা। আমি তোমার আংকেলের কাছ থেকে আসি। আচ্ছা আন্টি। আরো প্রায় ৩০ মিনিট কেটে গেল আমি এখানে একা বসে আছি। তেমন কেউ আমার কাছে এলেন না। মাঝে অবশ্য একবার ওই মেয়েটা এসেছিল। প্লেট দুটো নিয়ে গেলো আর বলল ভাইয়া আপনার কিছু লাগলে বলিয়েন। আমি অবশ্য আরেক গ্লাস ঠান্ডা পানি চেয়েছিলাম। সে খুব ঠান্ডা নয়, তবে চাপকল(টিউবওয়েল)  চেপে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়েছিলো। এ বাড়িতে যে খুব খারাপ কিছু হয়েছে সেটা টের পাচ্ছিলাম। এই আধা ঘন্টায় আমার কাছে কেউ না এলেও এ বাড়িতে অনেকে এসেছিলো। বিশেষত পাড়ার মহিলাদের কথা কানে আসতেছিলো ; - এই রুমকির মা। কিছু মুখে দে অনেক বেলা হয়ে গেছে। তুই আবার অসুস্থ হয়ে পড়বি। 

আরেকবার শুনলাম পুলিশে নাকি ফোন দিছে। পুলিশ কিছু টাকা চাইছে, টাকা দিলে নাকি আর কাটবে না( !) । একবার অরন্যের মা'র গলা পেলাম 'যত টাকা চায় দাও তবুও আমার কলিজার গায়ে যেন একটা ছুরির দাগ না পড়ে '! যেন বুকফাটা হাহাকারে আমার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে উঠল। চাপা কান্নার শব্দ ভেসে এলো কানে। যেন কয়েকটা মানুষ একসাথে কাঁদছে! 

নিজেকে অচেনা লাগছে। যেন অন্য কোন গ্রহে চলে এসেছি। উদাসী চিত্তে বাড়ির চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। দুইতলা বাড়ির ভিতরের সামনে দিকে  ফাকা আঙ্গিনা আছে। আঙ্গিনার শেষদিকে কয়েকটি গরু পালার শেড আছে। একটা গরু বাধা আছে এখনো। ডান পাশে একটা উপরে উঠার সিঁড়ি আছে। আগেই বলেছি নিচে কেউ থাকেনা। তবে একটা গেস্ট রুম আছে। বাম পাশের শেষে একটা টয়লেট আছে, আলাদা করে আরেকটা বাথরুম(গোসল খানা)  আছে। তার সাথেই লাগানো রান্না ঘর। এরপরে ড্রয়িং কাম ডাইনিং অর্থাৎ আমি যেখানে বসা আছি। আমার পেছনে গেস্টরুম। তারপাশে একটা স্টোর রুমের মতো একটা ঘর। আর সিঁড়ির সাথে আরেকটা তালাবদ্ধ  ঘর আছে।  

কিছুক্ষণ পর রুমকি এলো। ভাইয়া উপরে চলেন বাবা ডাকছে। 

আপনি রুমকি আপু তাইনা? 

জ্বি। আমার সাথে উপরে আসুন। 

উপরে সিঁড়ির সাথের বড় ঘরটাতে আমাকে নিয়ে এলো রুমকি। এই ঘরে এখন আমি, অরন্যের বাবা, মা রুমকি আর ওই মেয়েটা আছি। অরন্যের বাবা কথা বলা শুরু করলেন ;- অরন্য তোমায় খুব পছন্দ করত। বলত ইয়ামিন আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। সে ডাক্তারি পড়া শেষ করলে এখানে বেড়াতে আসবে। আর গত সপ্তাহ থেকে বলছিলো তুমি নাকি খুব তাড়াতাড়ি আসবে। অথচ দেখ বাবা তুমি ঠিকি এলে কিন্তু আমার অরন্য....... 

আর কিছু বলতে পারলেন না, উনার এবং আর সবার চোখে অশ্রু দেখে আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না। অরন্য এবং এর পরিবারের সাথে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে! 

 - অরন্যের কি হয়েছে?  সে কোথায়?  বললাম আমি। 

সবাই কাঁদছে। আপু অন্তুত আপনি কিছু বলেন?  চুপ করে থাকবেন না । অরন্য আপনাকে খুব ভালোবাসতো। 

- সে গত রাতে সুইসাইড করেছে। কথা বলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন আপু আর ওই মেয়েটি। 

আমি যেনো আর নিজেকে সংবারন করতে পারছিলাম না।  না। এ হতে পারেনা। অরন্যের মত মানুষেরা কখনো এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না? আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। এটা আত্মহত্যা নাকি খুন এটা আমাকে বের করতেই হবে। মসজিদ থেকে যোহরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে আর আমার মন বলছে এটা কোন ভাবেই সুইসাইড হতে পারেনা। নিশ্চয় পুর্ব পরিকল্পিত খুন । 


 (তিন)   

তাহলে এই মেয়েটির অরন্যের বউ হবার কথা ছিলো। অরন্যের পছন্দের তারিফ করতে হবে। পাশের গ্রামেই বাড়ি ওদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসীর ছাত্রী। মেয়েটির নাম তৃষা, বেশ ফর্সা, মুখটা একটু লম্বাটে, চোখদুটো যেন সবসময় কিছু বলছে,   চুলগুলো ঘন কালো আর পছন্দের রং সম্ভবত গোলাপি অথবা মেরুন। এবাড়িতে আসার পর তৃষার সাথেই অরন্যের বিষয়ে প্রথম কথা শুরু করলাম। 

 - তৃষা, আপনি কি কিছু বলতে পারবেন অরন্য কেন এই কাজটি করলো। এমন তো নয় যে সে কিছুদিন খুব ভয়ে ছিলো! ওর কোন শত্রু আছে কিনা। কিংবা আপনার সাথে হঠাৎ কোনো ঝগড়া করেছে কিনা? 

মেয়েটি আমার দিকে কেমন জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি আবার বললাম ; দেখুন মিস আপনাকে জিজ্ঞাস করছি কারন আপনার সাথে অরন্যের পারিবারিকভাবে বিয়ে হবার কথা ছিলো। আর আপনার সাথে ওর অনেক আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক। সুতরাং হয়ত অরন্য তার ভয়ের কথা ভালো লাগার কথা বলে থাকতে পারে! চুপ করে থাকবেন না । অথবা কিছুদিনের মধ্যে ও কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করেছে কি'না? 

- হ্যাঁ একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি। গত ক'মাস যাবত ও আমার সাথে কেমন আচরণ করছে কখনো কখনো এমন হয়েছে যে সে আমার সাথে ২-৩ দিন কোন যোগাযোগ করেনি। আমিই ওকে ফোন দিয়েছি বিশেষকরে রাতে সে কেমন আবোলতাবোল কথা বলেছে! পরে অবশ্য সরি বলতো। আর বলতো ইদানীং তার যেন মাথার ভিতর কেমন যন্ত্রণা করে, কেমন উদ্ভট কাজ করতে ইচ্ছা করে! 

- সে কি কোনো নেশা করতো? 

- না। কখনো নয়, আমার জানামতে সে কোনোদিন সিগারেট ও খায়নি। 

- আচ্ছা। আর এমন কোন কথা কি সে আপনাকে বলেছে যেটা আপনার কাছে খুব উদ্ভট লেগেছে? 

- আপনি হয়ত জানেন সে কেমন হেয়ালি করে কথা বলতো। তাই আমিও ওই কথায় ওইভাবে পাত্তা দিতাম না। গত একমাস থেকে সে আমাকে প্রায় বলতো মানুষ খুব সহজে কিভাবে মরতে পারে? মারা যাবার সহজ কৌশল কি? এ বিষয় নিয়ে ওর সাথে আমার দুদিন ঝগড়া হয়েছিলো। তবে বিশ্বাস করুন সে আত্মহত্যা করার মানুষ নয়!   

- আচ্ছা তৃষা আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার কথাই যেন ঠিক হয়। 

মেয়েটি এখনো শোক সামলে ওঠতে পারেনি। তবে কথাগুলো বেশ সাবলীলভাবেই বলল। রুমকি আপুর কাছ থেকে তেমন কিছু পেলাম না। অরন্যের বাবা মার সাথে একসাথেই কথা বললাম। উনারাও তেমন কিছু বলতে পারলেন না। তবে ওর ব্যবহারের মধ্যে ইদানীং কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যেমন সে অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। মাঝে মাঝে সারাদিন ঘুমাই যেন নেশা করেছে? ইদানীং ওর অনেক মেজাজ বেড়েছিল কারো কোন কথা মেনে নিতে পারতো না। তবে এ কথাও ঠিক সে কোনো রকম নেশা করতো না।       

এরপর আমি উনাদের অনেক অনুরোধ করে অরন্যের ঘরে গেলাম। উপরতলার মাঝের ঘরটিতে অরন্য থাকতো। ঘরটা বেশ বড়  ঘরময় অরন্যের স্মৃতিতে ঠাসা। সামনের দেয়াল জুড়ে অরন্যের কিছু ছবি সাথে ওর বিচ্চু বাহিনী আছে, কয়েকটি প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি, এই ঘরের রঙ ও অরেঞ্জ ও লালের মাঝামাঝি, ছাদ অবশ্য হালকা সবুজ। ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা খাট, একটি টেবিল -চেয়ার, আর একটা কাপড় রাখা আলনা। টেবিলের সাথে দেয়ালে একটা আয়না আর টেবিলের সাথে ডান পাশে একটা বুকশেলফ ও তাতে কিছু বই দিয়ে সাজানো। ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে শুধু চেয়ারটা ঘরের দক্ষিন কোনে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছে আর বিছানার হালকা খয়েরী রঙ্গের চাদরটা জড়ানো আছে। আমি ঘরময় চিরুনি অভিজান চালিয়ে খুজতে লাগলাম কোন ক্লু পাওয়া যায় কি' না! তেমন কিছুই পেলাম না। তবে একটু আশ্চর্য হলাম ওর টেবিল আর বুকশেলফ দেখে কে যেনো একটু আগেই সব গুছিয়ে রেখেছে। ওর ডায়েরি, খাতা, বই সবকিছুতে নজরদারী করলাম। হতাশ হয়েই বের হতে যাবো তখনি টেবিল আর বুকশেলফের ফাকে কি যেন চকচক করতে দেখতে পেলাম, - এক পাতা ফুরিয়ে যাওয়া ওষুধের খোসা। টেবিলটা একটু সরিয়ে বুকসেলফটা একটু নাড়িয়ে একি ওষুধের আরো কয়েটি ফাকা খোসা পেলাম। এবার একটু ভালো করে লক্ষ্য করলাম - Amytriptyline + Chlordiazepoxide   গ্রুপের একটা কম্বাইন্ড ড্রাগ! যা কি'না এ্যান্টি ডিপ্রেশন, রিলাক্সাশন ড্রাগ। যার ওভার ইউসের ফলে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম  (মস্তিষ্ক) ডিপ্রেস হয়ে যায়। এমনকি এই ড্রাগ ২৪ বছরের নিচের কাউকে রিকোমেন্ড করা হয় না। একজন ডাক্তার হবার দরূন অরন্যের মৃত্যুর কারণটা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেলো। 

ঘর থেকে বের হয়ে আমি একান্তে অরন্যের মা-বাবার সাথে কথা বললাম। 

 - আংকেল, অরন্যের খুনের ব্যাপারে আপনার কাউকে সন্দেহ হয়? 

- না বাবা। তার তেমন কোনো শত্রু নাই। আর সে তো নিজের ঘরেই মারা গেছে। 

- কোন পুলিশ কেইস হয়েছে কি? 

- না। বাবা আমরা চাইনা যে কোন কেস হোক? বললেন অরন্যের মা। 

- কেন? আপনারা কি চাননা ওর খুনের সঠিক বিচার হোক? 

- দেখ বাবা, যা হবার হয়েছে। এখন আবার আমরা নতুন করে চাইনা আমার ছেলেটাকে মর্গে নিয়ে ওরা আরো কুচি কুচি করে কাটুক! 

- আমায় মাফ করবেন আন্টি। ওর মৃত্যুর জন্য এই মেডিসিনটা দায়ী। উনাদের দিকে ওষুধের খোসা এগিয়ে দিলাম। আরো বললাম - আপনারা জানেন আমি ডাক্তার, আমার জ্ঞানে আমার এটাই অনুমান যে সে অনেকদিন ধরে এই ওষুধটা খাচ্ছে। আরো বুঝিয়ে বললাম যে এই ওষুধ খাওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে একটু দুশ্চিন্তায় আত্মহত্যা করার প্রবনতা দেখা দেয়। এ ওষুধ খেলে যেহেতু মস্তিষ্কে ডিপ্রেশন তৈরি হয় সুতরাং যেকোনো কথায় কারোর মেজাজ খারাপ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেটা অরন্যের বেলায় হয়েছে। আর এই ওষুধটা এ্যাডিকশন তৈরি করে এবং বেশ কয়েকটা ট্যাবলেট একসাথে খেলেই ভালো ঘুম হয়। 

তখন আন্টি বললেন হ্যাঁ সেতো এ ওষুধ আগেও খেত। খাট থেকে উঠে ড্রায়ার থেকে পলিথিন ব্যাগে এক পুটলা ওষুধের খালি খোসা আমায় দেখালো যেখানে ওই ওষুধের আরো খালি খোসা ছিলো! 

- আচ্ছা আন্টি,অরন্য  গত কয়েকমাসের মধ্যে কোন ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়েছে?   

- আমাদের জানামতে গত একবছরে সে তেমন অসুস্থ হয়নি!  কাপা কন্ঠে বলল অরন্যের বাবা। 

- আচ্ছা! তাহলে আংকেল রাশেদ, ডাঃ রাশেদ কে? 

- রাশেদ। আমার বোনের ছেলে। অরন্যের সমবয়সী, বন্ধু। সে অবশ্য ডাক্তার নয় ফার্মেসিতে ডিপ্লোমা করেছে। এখন আমাদের বাজারে একটা ফার্মেসীর দোকান দিয়েছে এবং মানুষদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। 

- আমি কি উনার সাথে কথা বলতে পারি? উনি এখন কোথায়? 

- সে তো অরন্যের কাছে আছে। হাসপাতালে। একটা পুলিশ কেস হয়ছিলো পরে আমরা আর কেস করিনি? পুলিশের সাথে মিটিয়ে নিয়েছি যেন আর আমার ছেলের পোস্টমর্টেম না হয়। 

- আংকেল আমাদের হাতে আর তেমন সময় নেই। রাশেদ সাহেবকে ফোন দিয়ে বলেন যেন অরন্যের লাশটা হাসপাতালে ফ্রিজিং করা হয়। ওর লাশ  কাল সকালে  দাফন করা হবে। আর হ্যাঁ আপনি গিয়ে পুলিশে নতুন কমপ্লেইন করান। আমি আর তৃষা হাসপাতাল যাবো। 

আমি আর তৃষা এখন নাটোর সদর আধুনিক জেনারেল হাসপাতাল মার্গের সামনে দাড়ানো। রাশেদকে আগেই ফোন করে জানানো হয়েছে আমরা আসছি। হাসপাতাল, মর্গ আমার কাছে নতুন নয়। এর আগে অনেকবার অটোপসি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত প্রাকটিক্যাল ক্লাস করেছি, সার্ফেস মার্কিং, হিউম্যান অরগান নিয়ে টানা হেচড়া করেছি। আর আজ এসেছি বন্ধুকে দেখতে! রাশেদ লাশের  ভালো ব্যবস্থা করেছে। নিজের ভাই ও হয়ত নিজের কাজ ব্যবসা ফেলে এভাবে সময় দিত না। আমি শুধু শেষবারের জন্য ফ্রিজ খুলে বন্ধুর মুখটা দেখলাম। চেহারাটা কেমন বিষাদময় হয়ে উজ্জ্বল শ্যামা মুখটি কালো হয়ে গেছে, চোখদুটো যেন কোটর থেকে বের হতে চাচ্ছে! মরার আগে প্রচন্ড ছটফট করেছে, - হয়ত বাচার জন্য শেষ চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি? 

মর্গগুলো কেমন শুনসান থাকে। অনেকে ভয়েও ও পথ মারায় না। মর্গের ভিতরেই এখন আমি, রাশেদ, তৃষা এবং একজন দাড়োয়ান আছেন। মেয়েটার নিউরনে প্রচুর উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, সে অনেকটা অস্বস্তি অনুভব করছে চেহারায় স্পস্ট।আমাদের মাথার উপর একটা কলিজা রংয়ের(রেডিস ব্রাউন) ফ্যান নির্দিষ্ট গতিতে অদ্ভুত শব্দে ঘুরে চলেছে। ফলে শব্দ-ছন্দের খেলায় ভৌতিক আমেজ তৈরি করছে! যেখানে তৃষার নির্লিপ্ত চাহনি যেন মৃত মানুষের ঘরময় পদচারণা নজরদারি করছে।   দাড়োয়ান চায়না আমরা কেউ আর ভিতরে থাকি। দাড়োয়ানকে আমার পরিচয় দেওয়াতে একটু শান্ত হলো এরপরেও যেন খুব বেশি সময় না থাকি এটা বলে উনি বাইরে চলে গেলেন। আমি তৃষাকে বললাম আপনি দয়াকরে ক্যান্টিনে অপেক্ষা করুন আমরা খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো। 

এখন মর্গের ভিতরে আমি আর রাশেদ। মর্গের কোনায় পাতা চেয়ারে রাশেদ বসা তার সামনে টেবিলটা টেনে আমি বসেছি। রাশেদ আগে কথা বলা শুরু করলো ; 

 - আপনি তাহলে ইয়ামিন। আপনার নাম শুনেছি কিন্তু দেখুন আপনি এমন দিনে এলেন যেদিন কিনা আপনার বন্ধু পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো। 

- তাহলে আপনি দেখছি আমার আসাতে খুব খুশি হোন নি? 

- আরে না না, তা হতে যাবে কেন? তাছাড়া আপনি নাকি বলেছেন যে কি একটা ওষুধের কারণে নাকি অরন্য মারা গেছে? তারুপোর আপনি আবার ডাক্তার মানুষ! যদিও আপনার উপর আমার কোনো সন্দেহ  নাই। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন যদি ব্যপারটা গ্রামের মানুষ জেনে যায় তারা কি আপনাকে সন্দেহ  করবেনা? 

- হুম। তা আপনি ঠিকি বলেছেন। আমার আসার সময়টা আসলেই বাজে হয়ে গেলো। 

- হু৷ যাকগে আপনি নাকি অরন্যের ব্যপারে আমায় কিছু বলতে চান? বলুন যদি আপনার কোনো উপকারে আসতে পারি। 

- আচ্ছা রাশেদ সাহেব আপনি কি করে জানলেন যে অরন্যর মৃত্যুর পেছনে ওই ওষুধ দায়ী   ? 

- দেখুন.... একটু থেমে আবার বলল। আপনিই তো বাসায় বলে এসেছেন। আর মামা-মামী তো আমাকে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসেন। আর আপনি কি সন্দেহ করছেন আমাকে? 

- আরে ছি!  ভাই বলেন কি আপনাকে সন্দেহ করতে যাবো কোন দুঃখে? চলুন এবার যাওয়া যাক। 

রাশেদ যে ধড়িবাজ এটা ওর কথায় বুঝলাম কিন্তু সে ভয় পেয়েছিল কেন বুঝলাম না, কেননা এই সময়ে ও প্রায় ঘেমে গিয়েছিল  আর চেহারাটাও কেমন লাল হয়ে উঠেছিলো। তবে ও যে একটা ষড়যন্ত্র করেছে কিংবা ষড়যন্ত্রের অংশ এটাতো বুঝা গেল। কিন্তু এ ষড়যন্ত্রের অন্য প্রান্তে কেউ তো আছে যার সাথে রাশেদের সবসময় যোগাযোগ চলছে? 


(চার)  গল্প শেষের গল্প, 

 পুলিশ রাশেদ আর তৃষাকে গ্রেফতার করেছে। দুজনেই তাদের অপরাধ স্বিকার করে নিয়েছে। আমার দেয়া অরন্যের চিঠিটাকে মুল প্রমান করে আর অরন্যের মায়ের প্রাথমিক সাক্ষ্য তে প্রথমে রাশেদকে গ্রেফতার করা হয় আর পরে তৃষাকে মামলার প্রমান সরানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। কেননা অরন্যের ঘরের জিনিসপত্র আমি অগুছালো করে রাখি এবং ওষুধের খোসাগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে রাখি এবং সেটার ছবি আমার মোবাইলে তুলে রাখি এ ষড়যন্ত্রের আরেক হোতাকে ধরার জন্য। পরবর্তিতে দেখা গেল তৃষা ওগুলো পুনরায় গুছিয়ে রাখে এবং ওষুধের খালি খোসা সরিয়ে ফেলে। পরে রাশেদ ও তার একমাত্র ও প্রধান সহযোগী হিসেবে তৃষার নাম উল্লেখ করে। পরবর্তীতে রাশেদ পুলিশকে জবানবন্দি দেয় এই ভাবে ;

আমি রাশেদ। আমার বাবার পরিবার খুব স্বচ্ছল ছিলোনা। তারুপোর আমি যখন ছোট তখন বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। এরপর মা কয়েকবছর বাবার বাড়িতে থেকে যান। যদিও আমার কথা ভেবেই মা আর কোন বিয়ে করেননি। কিন্তু ও বাড়িতে আমরা সুখে ছিলামনা। মা অনেক কাজ করতেন পরিবারের তবুও অন্য কারোর মন ভরতো না। কোনমতো দুমুঠো খেয়ে দিন কাটতো আমাদের। আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠি তখন আমার চাচা চাচিরা বললেন আমার পড়ার আর দরকার নাই! আমি যেন চাচার মুদি দোকানে গিয়ে চাচাকে সাহায্য করি। এ পর্যায়ে মা ও বাড়ি ছেড়ে মামার কাছে চলে আসেন। অতপর আমাদের দিন ফিরলো। কিন্তু ততদিনে আমি শিখে গেছি কিভাবে সবচেয়ে কমখরচে বেশিদিন বাঁচা যায়। এ বাড়িতে আমি মামার কাছে থেকে অনেককিছু না চাইতেই পেয়েছি। অন্যদিকে অরন্য যা চাইতো তাই পেত। আমারো অবশ্য বায়না ধরতে ইচ্ছে করতো, কিন্তু মা আমাকে থামিয়ে দিতো! ছাত্র হিসাবে অরন্যের চেয়ে খুব খারাপ ছিলাম না। কিন্তু এসএসসির পরে আমায় ভর্তি হতে হলো ডিপ্লোমা তে। ফার্মেসিতে ভর্তি হলাম। সবাই বলল তিন চার বছর পর থেকে চেম্বার করা যাবে রোগী দেখা যাবে। আমার মা গর্ব করে বলতেন আমার ছেলে সরকারি প্যারামেডিকেলে চান্স পাইছে। অথচ আমি মেডিকেলে পড়তে চেয়ে ছিলাম! একদিন ফার্মাকোলোজি পড়ার সময় পেলাম ওই ড্রাগের নাম আর হঠাৎই আমার মাথায় সেই চিন্তা খেলে গেল।   যদি একবার খাওয়ানো যায় এরপর আস্তে আস্তে ও (অরন্য) হবে শেষ আর ওর সব সম্পত্তির মালিক হবো আমি। তৃষাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনতাম, সে ছিলো আমার চাচাতো বোন।    ওর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক যখন তৃষা ক্লাস নাইনে পড়ে। একদিন এলো সেই দিন একবার আমি আর অরন্য একবিয়েতে গেছিলাম তখন অরন্যের সাথে তৃষার পরিচয় হয়। তখন সে জানত সে(তৃষা) আমার কাজিন। একদিন সে আমাকে বলেই ফেলল রাশেদ তোর চাচাতো বোনকে না আমার খুব ভালো লেগেছে। তুই কিছু একটা কর? তখনি আমার চিন্তাটা একটা পরিপিক্ক প্লানে পরিনত হলো। আমি তৃষাকে বুঝিয়ে বললাম ; - দেখ তুমি যদি ওর সাথে প্রেমের অভিনয় করো আখেরে আমাদের ই লাভ। যদি তোমাদের বিয়েও হয়ে যায় এরপরে সে মারা গেলে ওর সব সম্পত্তির মালিক হবো আমরা। তাছাড়া তুমি ওর সাথে প্রেমের অভিনয় করবা আর ওকে বিভিন্নরকম মানসিক চাপ দেবে পরেরটা আমি দেখছি? এরপর হঠাৎ ই অরন্য বলে সে তৃষাকে বিয়ে করতে চায়,  কেননা তৃষা অনেকদিন থেকে ওকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে? হঠাৎ অরন্য রাজি হওয়াতে তৃষাও বুঝতেছিলোনা কি করবে ও। দু পরিবারের সবাই রাজি। তাই তৃষা অরন্যকে সরাসরি না করে দেয়। তাছাড়া আমি অরন্যকে এই ড্রাগ দিচ্ছি গত দেড়বছর যাবত এবং গত ছমাসে সে অধিক পরিমাণে এই ড্রাগ নিয়েছে। আমারি কপাল খারাপ হয়ত ইয়ামিন না আসলে কেউ জানতোও না অরন্য কেন মারা গেল? একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে সত্যি ভালোবাসলে অন্যজন কখনো ফিরিয়ে দেয় না সে আরো কাছে চলে আসে।। 

নাটোর লোচনগড়ে এখন অরন্যকে সবাই চেনে। এখানে একটা নতুন বাচ্চাদের স্কুল চালু হয়েছে "অরন্য বিদ্যানিকেতন "। আপাতত শুন্য থেকে তৃতীয় শ্রেনী পর্যন্ত সম্পুর্ণ বিনামূল্যে পড়ানো হচ্ছে। স্কুলটির স্লোগান হলো ' কোন শিশু আর করবে না কাজ '। 

আর আমি রাশেদের ফার্মেসিতেই চেম্বার খুলেছি। আপাতত মাসে দুদিন বসবো। তবে ফার্মেসিটার নাম পরিবর্তন করেছি ' অরন্য কেমিস্ট এন্ড ড্রাগ হাউস '।        

ভেবেছিলাম অরন্যের অপেক্ষার পালা শেষ হবে! কিন্তু সেটা আর হলোনা। অরন্য নিজেকে মুক্তি দিয়েছে হয়ত, কিন্তু ওর সমস্ত কাজের বোঝা আমায় চাপিয়ে দিয়ে গেছে। এ অপেক্ষার শেষ হলো না। অরন্যের অনেক স্বপ্নপূরণ বাকি এখনো। আজ যাচ্ছি কিন্তু আবার ফিরে আসতে হবে নতুবা পুরো গ্রামের অপেক্ষায় থাকবে।।                                                                 

                                                                 

Sunday, May 5, 2019

কবিতা

তবুও ভালোবাসি
মুহাম্মদ নাজমুল হক

এই যে , আমার অফুরন্ত সময়
আমার নিষিদ্ধ রাত ।
ধর , আমি একলা ,
নিঃসঙ্গ তো ওই চাঁদ ।
তবুও  ভালোবাসি  ।
ভালোবাসে ওই পথিকটাও , বন্ধুর মরিচিকা ভরা পথ ।
কে জানে ওই চাঁদ নয় , এই জোনাকীটাই শেষ সম্বল !
তবুও ভালোবেসে যায় ।
ওই চাঁদ , আলো ,অন্ধকার আবার এই অরণ্য কিংবা সমুদ্রের গর্জন ।
জানি,ঝড় আসবে অমবস্যায় ।
হইহুল্লোড় দৌলে , শান্তির প্রার্থনা ।
রোগ-শোক মৃত্যু ভয় ,দুঃচিন্তা অবিরাম ।
কালকেও বাঁচতে হবে - জীবনযুদ্ধ !
কটাক্ষ করে শত্রু , অনুপ্রেরনায় মিত্র ।
বাঁচতে যে হবে ,- অপেক্ষা ।
তবু ভালোবাসি অনুপ্রেরণা ।
আর প্রতিক্ষা নয় , অপেক্ষা
আর একটু সঞ্চয় কর ধৈর্য্য ।
আমি আসছি ,- অনুপ্রেরণা ।
তবুও ভালোবাসি ।

Saturday, May 4, 2019

বন্ধু বিচ্ছেদ

মুহাম্মদ নাজমুল হক

আমি তখন মেডিকেলে সেকেন্ড প্রোফের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আর তখনি যে এমন একটা ঘটনা ঘটবে, আর আমার জীবন এভাবে বদলে যাবে তা কখনো ভাবিনি। ওই সময়টাতে আমি আমার একাডেমিক পড়ার পাশাপাশি অনেক বই পড়তাম। আর রোমাঞ্চকর  কিংবা গোয়েন্দাগিরি আমার পছন্দের প্রথম দিকে থাকত। সেই সুত্রে শার্ল্কস হোমস খ্যাত স্যার আর্থার কানন ছিলেন প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব।
তো ঘটনাটা যা ঘটেছিল ; ওই সময়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়া তিন বন্ধু। মুশফিক, মাহতাব আর ইয়াসমিন যাদের বন্ধুত্বের বন্ধন এতটাই শক্তিশালী যে এদের আলাদা করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। ***
তারা ব্রিলিয়ান্ট তাতেও কারোর কোন সন্দেহ ছিলনা। এদের ধৈয্য নিয়েও গর্ব করার মত। সারাদিন গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকে। তাদের বেশ কয়টা প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছিল দ্যা ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মেডিসিন এ।
একদিন এলো সেই কলঙ্কিত দিন। কলেজের করিডোরে লাইট ক্যামেরার ফুলঝুরি, যেন কোন হলিউডি সিনেমার শুটিং চলছে। আসলে প্রেস মিডিয়া আর পুলিশ  যাদের এখানে আসার কোন কথা ছিলনা।
সময়টা তখন রাত ৮ঃ৪০মিন, বড়জোর ৯টা হবে। আমি হোস্টেলের ডাইনিং থেকে রাতের খাওয়া শেষ করে আমার ঘরে এসেছি মাত্র। এরপর পুলিশের গাড়ির শব্দ একটা এ্যামবুলেন্স আর কতগুলো মানুষের চেঁচামেচি।
মাহতাব মারা গেছে। আমাদের মেডিকেলের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ নিমাই চন্দ্র তা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু কিভাবে মারা গেছেন? আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে ওর হার্ট ফেইলিওর হয়েছে। মৃত্যুটা আসলেই কি স্বাভাবিক নাকি মার্ডার তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা। মৃত্যুর খবরটা ইয়াসমিন ই প্রথম ফোন করে নিমাই স্যারকে জানান। এখন ডাঃ মোঃ রহিম উল্লাহ স্যার এসে গেছেন। উনি আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ। মাহতাবের লাশটা দেখে ডাঃ নিমাই কে শুধু বললেন কিভাবে হলো তুমি কি কিছু জানতে পেরেছো। উনি বললেন ওরা তিনজন মিলে আজ প্রায় আট ঘন্টা ল্যাবে ছিল। আর মাহতাবের মৃত্যু হয়েছে এখন প্রায় ৩০ মিনঃ আগে। অন্য দুজন কোথায়? স্যার আপাতত ওদের ল্যাবেই আটক করে রাখা হয়েছে আপনি কি বলেন তার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছি।
মাহতাবের বাসা ঢাকার কেরানিগঞ্জ। এতক্ষণে ওর মা বাবা চলে এসেছে। মা বলা শুরু করলো মাহতাব কই আমার মাহতাব কই ওর মুখটা আমারে দেখাও ; এইবার আমার দেখার সুযোগ হলো মাহতাবের লাশটা। আমি কিছু ভাবছি তখনি মাহতাবের মা চিৎকার দিয়ে বলে ওঠলে না আমার মানিক এমনি এমনি মারা যায়নি ওরা একে বিষ খাইয়ে মেরে দিছে, আপনারা দেখছেন না ওর শরীর বিষে কেমন নীল হয়ে গেছে? উনি মনে হয় আমাদের সবার কাছেই প্রশ্ন করে ফেললেন। আপ্নারা কেমন ডাঃ আমি বলে দিচ্ছি যারা আমার মাহতাবকে মেরে ফেলেছে তারা যেন কোনভাবেই পার না পায়। সত্যি তো মাহতাবের সমস্ত শরীর নীল হয়ে আছে, চোখ দুটো কেমন বের হয়ে আসছে, যদিও চোখে হাতটা আমার নিজের তদন্তের স্বার্থে দেয়া। আর শরীরটাও প্রচুর ঠান্ডা, চামড়া গুলো কেমন নেতিয়ে গেছে। আমার অবসারভেশন থেকে মনে হচ্ছে এর মৃত্যু আরো অন্তত তিন ঘন্টা আগে হয়েছে। কেমন সবকিছু আমার কাছে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। যদি মাহতাবের মৃত্যু হয়ে যদি এক ঘন্টাই হয়ে থাকে তবে ওর শরীরের এই হাল কেন?  তার মানে কি এটা প্রিপ্লানেড মার্ডার?
*****চলবে****

Friday, February 8, 2019

কবিতা

প্রিয়দর্শিনী
মুহাম্মদ নাজমুল হক

তোমারে দেখেছিলাম সাঁঝের বেলা
ফাঁকা রাস্তা ওই বুড়ি বিলের ধার,
ডুব সূর্যের রক্ত-দীপ্ত মুখমণ্ডল রাঙা।

সাঁঝের মায়া বুঝিনি আগে,
যদি না দেখা হত তোমার
বুঝেছি এখন দেখে তোমায়
                - ভুল খোয়াবে জেগে।
এরপর দেখেছি দেখেছি তোমারে
                                  - বার বহুবার।
বাস দাঁড়ানো ওই মোড়ে।
রেলের সর্পিল রাস্তা ধরে,
                  - আরো অনেকখানি।
বসেছিলাম ওই প্লাটফর্মে
তুমি আমি মুখোমুখি।

দেখেছি তোমার হারিয়ে যাওয়া
                     - ওই ভিড়ের মাঝে।
তখনো ছিল সন্ধেবেলা
                 - সাঝের মায়ার ঘোরে।

হয়নি ছোয়া তোমায় কখনো
হয়নি কথা আজো।
দেখেছি তোমার গোলাপ ঠোঁটের
                       - হাসির ফুলঝুরি।
ওগো! প্রিয়দর্শিনী -
কত! আর কত বেলা,
খেলবে তুমি আমায় নিয়ে
                 - সাঝের মায়া খেলা।

Friday, January 4, 2019

কবিতা

পবিত্রায় অনুরক্তি
মুহাম্মদ নাজমুল হক

তুমি পবিত্র,
তুমি নিষ্পাপ,
তুমি যখন ঘুমিয়ে যাও গল্প শেষের আগে,
হয়ত তখন বিদ্যুৎ ছিন্ন থাকে,
আর তখন পূর্ব জানালায় আসা ভরা
জোসনা পড়ে তোমার মুখে,
আর তোমার পছন্দ ঘরে
মোমবাতি জ্বালানো।

বাইরের নীলজোসনা আর ঘরের লাল আলোর আলিঙ্গন।
তুমি এও জানোনা, ততক্ষণে
ঘরের গুমট গরমে, তোমার -
দুচোখের নিচে আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে,

হয়ত সেখানেই আলিঙ্গনে মেতেছে আলোরা।
তখন আমার ইচ্ছে করে কী জানো?
- ইচ্ছে করে তোমার বানানো শখের হাত পাখার বাতাসে মুছে দি-
 তোমার ঘামগুলো।

কিন্তু আমি তা করিনা, কেন জানো?
কারন, কাল যদি আর এই পবিত্র মুখ না দেখতে পাই।
আমি চাই এ মূহুর্তটা আর না শেষ হোক।
আর একটা কথা বলি, যা আগে তোমায় বলা হয় নি,
এই মুখটাকে  আমি প্রচন্ড ভালবাসি।

তুমি কি এটা জানো -
তোমার মুখে জমা ওই বিন্দু ঘামে যখন -
আলোর প্রতিফলন হয়। - আমি শত রংধনু দেখতে পাই।

অতঃপর, হঠাৎ ঘরে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে ওঠে।
তারপর তোমার কর্নিয়া টা অনিয়ন্ত্রিত নড়ে ওঠে।
তোমার কর্নিয়ায় থাকা পিউপিল গুলো কিছুক্ষনের জন্য সংকুচিত হতে থাকে।

এর কয়েক মূহুর্ত পর ঘুম ভেঙ্গে,
ঘুম জড়ানো স্বরে তুমি বলে যাও -
এই তুমি এখনো ঘুমাওনি,
- আর এভাবে বসে আছো কেন,
আর ওমন ভুতের মত আমার দিকে কি দেখছ?

আর আমি কোন জবাব না দিয়ে, ব্যাস্ত হয়ে পড়ি ঘরে আলো নিভাতে হবে।
অতঃপর তোমার কপাল থেকে চুল হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলি ঘুমাও।

আর তুমি আমার হাতটা তোমার ডান হাতে নিয়ে একটা চুমু খেয়ে বলো -
তুমিও ঘুমাও।

অথচ!  আমি বলতে চেয়েছিলাম -ভালোবাসি তোমায়, প্রচন্ড ভালোবাসি তোমায় পবিত্রা।।